শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৭ অপরাহ্ন
সোহেল খান দূর্জয় নেত্রকোনা :
নেত্রকোনা তারিখ ০৬.০৩.২০২৩ ইং পালকি চলে হুন্হুনা.গ্রাম-বাংলার হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য পালকি। এ বাহনে চড়া দারুণ মজা। আগের অনুভূতি আর বর্তমান অনুভূতির অনুভব মনে হলে নিদারুণ কষ্ট হয়। বিয়ে উৎসবে পালকির কদর ছিল সবচেয়ে বেশি। একটা সময় ছিল বিয়েতে পালকি চাই। গ্রামীণ আঁকা-বাঁকা মেঠো পথে, কখনও আলপথে বর-কনে পালকি চড়ে উভয়ের শ্বশুর বাড়িতে আসা-যাওয়ার আনন্দঘন একটা দারুণ সময় ছিল। গাঁও-গ্রামের পথে পালকিতে করে নববধূকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে মন জুড়াত গাঁওয়ের বধূ, কখনও মা-চাচি, উঠতি বয়সের চঞ্চল মেয়েরাও বাদ পড়েনি।
পালকি মানুষের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহন ছিল। বড় ভাইয়ের বন্ধুর বিয়েতে নতুন বধূকে আনতে এলাকা থেকে নেত্রকোনার কোনো এক গ্রাম থেকে বেহারার পালকি কাঁধে বহন করার দৃশ্যকাব্য এখনও মনে পড়ে। পেছনে বর যাত্রীরা কেমন করে গন্তব্যের পথে নবীন, প্রবীণ, তরুণ, তরুণী, বালক-বালিকারা পুরনো দিনের গল্প আর হৈ-হুল্লোড় আর দুষ্টুমিতে আনন্দধারা চলার দৃশ্য দেখেছি, তা এখনও মনে পড়ে। পালকি যখন গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয় তখন কাঁচা-মাটি, কখনও আলপথ, কখনও মেঠোপথে হেঁটে পদ্মার কূলঘেঁষে তিন যুগ আগে বিক্রমপুর বিয়ে অনুষ্ঠানে গিয়েছি। ওই বিয়েতে গিয়ে তার মজা আজও আচমকা অনুভব করি।
বিয়ের দৃশ্যপট অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা ভোলার নয়। সাধারণত বর-কনের জন্য পালকি হলেও এ বাহনটি ছিল রাজরাজাদের একমাত্র বাহন। আধুনিক আমলের গাড়ির প্রচলন ছিল না বলে অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা পালকিতে চড়েই যাতায়াত করত। পালকি রাজা-বাদশাদের জন্য চেয়ারের মতো করে নির্মাণশৈলীতে তৈরি করা হতো। পালকির অপর নাম ছিল পালঙ্ক। এপার-ওপার দু’বাংলায় পালকি নামেই পরিচিত। তবে কোনো কোনো জায়গায় পালকিকে ডুলি বা শিবিকা ও দোলনা হিসেবেও চেনে। বরকে যখন পালকিতে বেহারারা বহন করে নির্দিষ্ট ছন্দের তালে তালে, তাল মিলিয়ে নেচে-গেয়ে পা ফেলে চলত। তখন মন কেড়েছে। তার অনুভূতি এখনও অনুভব করি। পালকি সচরাচর দু’রকমের হয়ে থাকে যেমন আয়না পালকি ও ময়ূরপঙ্খি নামেরও স্থান পায় কোনো কোনো এলাকায়। পালকিতে পাখি, পুতুল ও লতাপাতার নকশা মানুষকে বিমোহিতও করত।
গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বিয়ে অনুষ্ঠানে বর-কনের জন্য পালকি ব্যবহারের নিয়ম প্রথা চালু ছিল। তবে প্রকৃতি থেকে একেবারে বিলীন না হলেও হয়তো কোথাও কোথাও এখনও টিকে আছে। ধারণা করে যেতে পারে বিলুপ্তির পথে।
প্রচীনকাল থেকেই রাজা-বাদশারা এবং জমিদার শ্রেণী ছাড়া বেহারাদের প্রতি তেমন একটা সুনজর ছিল না, কোনো রকমে বেহারাদের জীবন ও জীবিকা চলত। সেই সময়ে স্থায়ী বেহারা রাখা ছিল খুবই ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা এবং চতুর্দশ শতকের পর্যটক জন ম্যাগনোলি-এর ভ্রমণের সময় পালকি ব্যবহার করতে দেখেছেন। প্রাচীনকালে বাহকদের সাজ পোশাকেও ছিল রকমারি পাগড়ি পাশাপাশি গায়ে থাকত লাল রঙের ব্যয়সাধ্য জোব্বা। এক সময় নেত্রকোনার সাতপাই সরকারি কলেজ সংলগ্ন বেহারাদের আবাসস্থল ছিল। তবে বেহারারা বাপ-দাদার নিয়ম প্রথা এখন আর মানছে না, ভিন্ন পেশায় জীবন চলে। ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহন পালকি আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। পালকি এখনও কোথাও কোথাও দেখা যায়। বিশেষ করে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে লোক ও কারুমেলায় বর-কনের বিয়ে অনুষ্ঠানে প্রকৃত পালকির অনুরূপ ককসিড দিয়ে বানানো পালকি দেখা যায়।